সমস্যার ভারে জর্জরিত ঢাকা শহরের একটি সহনীয় এবং বহনীয় ভবিষ্যৎ চিন্তা করা কি সম্ভব? এ রকম একটি ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে হলে সবচেয়ে আগে যেটা নিয়ে ভাবতে হবে তা হলো ঢাকার যানজট। নগরজীবন নিয়ে যে কোন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ঢাকাবাসীর হাহাকার যানজট নিয়ে। ঢাকার যানজট শুধু রাস্তার সমস্যা নয়, বরং এটি অনেকগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সমস্যার সামগ্রিক ফল। ২০০৮ সালে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক জরিপে ঢাকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা শহরের মধ্যে দ্বিতীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই জরিপে ঢাকার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে, প্রতিদিন রাস্তার যানবাহন থেকে যে বিষবাষ্প বেরুচ্ছে, তা ঢাকাকে বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে অনেক নিচে নামিয়ে এনেছে। আসলে যানজট শুধু বিভিন্ন সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুই নয়, এটি একইসঙ্গে সামাজিক ও অর্থনেতিক নানা সমস্যাও তৈরি করছে। নগরবাসী মাত্রেই জানেন, তীব্র যানজটের ফলে ঢাকার বাসযোগ্যতা এবং পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগের সম্ভাবনা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তো বটেই, এমনকি অর্থনীতিবিদরাও প্রায়ই ভুলে যান যে, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে আসার আগে একটি শহরের বাসযোগ্যতাকে প্রথমেই মূল্যায়ন করেন।
প্রশ্ন হল, ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধানে বাধা কোথায়? এই সময়ের তীব্র যানজট পরিস্থিতিকে শুধুমাত্র নগরায়ন অথবা সড়ক প্রকৌশলের সমস্যা ধরে নিলে যানজটের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামাজিক উৎসগুলোকে সম্পূর্ণ ভূল বোঝা হবে। যানজট সমস্যার সমাধানের জন্য সমাজের বিভিন্ন দিককে দেখতে হবে ৩৬০ ডিগ্রিতে। মধ্যবিত্তের নগর পরিবেশ নিয়ে প্রচলিত ভাবনাগুলো কী, সেটা প্রথমে বুঝতে হবে। মধ্যবিত্তের গতানুগতিক ধারণায় ঘর বা অফিসের বাইরে যাওয়া মানেই বিভিন্ন ধরনের বাস্তব ও কল্পিত যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ: ছিনতাইকারীর হুমকি, ট্রাকের নিচে পড়ার আতঙ্ক, দূষিতবাতাসের ভয় অথবা চাঁদাবাজির শিকার হবার সম্ভাবনা। মধ্যবিত্তের কাছে বাইরের জগৎটা প্রায় পুরোপুরি নেতিবাচক। এতোটাই নেতিবাচক যে, সেটা যতো এড়ানো যায়, ততোই যেন ভাল!
এ ধরনের নগরবিরোধী ধারণার প্রতিক্রিয়া হয় দু ধরনের । প্রথমত, প্রয়োজন ছাড়া ঘর এবং কর্মস্থলের বাইরে যেতে মধ্যবিত্তের মধ্যে অনীহা দেখা যায়। এই অনীহাই আবার ঢাকা শহরে সুস্থ ও সুন্দর নগরজীবন গড়ে না ওঠার পেছনে অনেকটাই দায়ী। অথচ যে কোন নগরবিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে নাগরিক চত্বর এবং রাস্তা হলো একটি বাসযোগ্য ও স্বাস্থ্যকর শহরের মৌলিক উপাদান।
দ্বিতীয়ত, ঘরের বাইরে যেতে অনীহার ফলে শহরবাসী এক ধরনের নগরবিরোধী মনস্তত্বেও শিকার হয় নিজের অজান্তেই। রাস্তায় যত্রতত্র থুথু ফেলা, খোলা নালায় ঘরের আবর্জনা ছুঁড়ে ফেলা, নিজের বাসার বাইরে পরিবেশের কী হচ্ছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র না ভাবা, নগর পরিবেশের প্রতি সহমর্মিতার অভাব, ভূমি দখলের নিরন্তর চেষ্টা– এ ধরনের যাবতীয় অপব্যবহার মূলত নগরবিরোধী মনস্তত্বেরই প্রতিফলন। এর সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হল- এই ধরনের অপচেতনা দেশের রাজনৈতিক এবং নীতিমালা প্রণয়ন মানসিকতায়ও জাল বিস্তার করে। রাজনৈতিক সরকার যখন একপাক্ষিকভাবে গবেষণা ছাড়াই শুধুমাত্র ফ্লাইওভার নিয়ে চিন্তা করে অথবা ‘মাস্টারপ্লান’ কেন্দ্রিক পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ থাকে; তখন তা হয় নগর সমস্যার সামাজিক ব্যপ্তি না বোঝারই ফসল। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব কিছুর সঙ্গে যানজটের সম্পর্ক কী? যদি ঘরের বাইরে যাওয়াটা হয় এক ধরনের সামাজিক যন্ত্রণা, তাহলে মধ্যবিত্তের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হবে বাইরের জনপরিবেশে এক ধরনের ব্যক্তিগত স্থান বা ‘বাবল’ তৈরি করা। ওই ‘ব্যক্তিগত স্থান’ হলো গাড়ি, ঘর বা অফিসের বাইরে মধ্যবিত্তের আশ্রয়। মধ্যবিত্তের চেতনায় গাড়ির দুটো ফসল: একদিকে গাড়ি এক ধরনের আরামদায়ক নিরাপত্তার ধারণা দেয় এবং অন্যদিকে গাড়ি হলো সামাজিক সম্মানের সবচেয়ে ফলোৎপাদক প্রতীক। ঢাকা শহরে এখন প্রতিদিন আনুমানিক ১৮০টি নতুন নিবন্ধিত গাড়ি রাস্তায় নামছে। এর অর্থ হচ্ছে বছরে ৪০ হাজারেরও বেশি নতুন গাড়ি যোগ হচ্ছে ঢাকার রাস্তায়। অথচ রাস্তার দৈর্ঘ্য বাড়ছে না।
যখন শহরে একটি চলমান জনপরিবহন ব্যবস্থার অভাব থাকে, তখন যার সামর্থ্য আছে তিনি গাড়ি কিনবেন অথবা কেনার স্বপ্ন দেখবেন। এই ধরনের মানসিকতার ফলাফল কেমন হতে পারে? ধানমণ্ডির একটি অভিজাত স্কুলের কথা ভাবুন। যদি ওই স্কুলে ৩০০ ছাত্রছাত্রী থাকে, তাহলে খুব সম্ভবত দেড়শ ছাত্রছাত্রী স্কুলে আসবে গাড়িতে তাদের ব্যক্তিগত ‘বাহন’ দিয়ে। এর ফলে স্কুল শুরু এবং শেষের সময়ে ধানমণ্ডিতে তীব্র যানজট হওয়াই স্বাভাবিক। তাহলে চিন্তা করুন ধানমণ্ডির স্কুলগুলো কীভাবে শহরের গতি কমিয়ে দিচ্ছে। উল্টো পিঠে এবার ভাবুন, যদি এমন একটি ব্যবস্থা করা হয় যে স্কুলের নিজস্ব পরিবহন এবং নিরাপত্তাকর্মীরা ধানমণ্ডির নির্দিষ্ট কিছু স্থান থেকে সমবেত ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে নিয়ে আসবে এবং স্কুল ছুটির পর বাসায় পৌঁছে দেবে, তাহলে অনেকগুলো গাড়ি রাস্তা থেকে উঠে যাচ্ছে। ভারতের মুম্বাই আমাদের প্রতিবেশী শহর, যার জনসংখ্যা আর সামাজিক পরিস্থিতি ঢাকার মতোই। সেই মুম্বাইয়ের স্কুল পরিবহন ব্যবস্থা যদি তাদের নগর পরিকল্পনার অংশ হয়ে থাকে, তাহলে আমরা কেন একই ব্যবস্থা ঢাকায় করতে পারছি না?
ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধান করতে হলে মধ্যবিত্তের নিরাপত্তা এবং সামাজিক সম্মানবিষয়ক মনস্তত্বের বিকল্প তৈরি করতে হবে। এটা সম্ভব একটি বিকল্প গ্রহণযোগ্য জনপরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে। কলাম্বিয়ার রাজধানী বোগোটার কথা ধরুন। দক্ষিণ আমেরিকার এই অপরাধপ্রবণ শ্রেণীবিভক্ত শহর নব্বই দশকের শেষ দিকে তার নগর পরিবেশের আমূল পরিবর্তন করেছে ট্রান্সমিলেনিও নামে একটি শহরব্যাপী ও টেকসই জনপরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে। সেখানে লালরঙের বাসগুলো শুধু শহরের চলাচল ব্যবস্থাকেই দক্ষ করে নি, বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণীকে একসাথে এনে শহরের সামাজিক ভারসাম্যকে করেছে শক্ত। একইসঙ্গে কমিয়েছে অপরাধ প্রবণতাও।
যেহেতু মধ্যবিত্তের চেতনায় ঢাকার নগর পরিবেশ অনিরাপদ, সমকালীন ঢাকায় হাঁটার সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। সকালে স্বাস্থ্য রক্ষার হাঁটা এবং দোকানে যাবার হাঁটা একটা শহরকে পথিকবান্ধব করে না। যে কোন নগরবিদের দৃষ্টিতে একটি চলমান শহরের পরিচিতি নির্ভর করে তার মানসম্পন্ন ফুটপাতের ওপর। ঢাকার ফুটপাত সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে রাজনৈতিক মাফিয়ার স্থানীয় মাস্তানদের সড়ক-বাণিজ্যের ভেতরে। পথিকবান্ধব নাগরিক সংস্কৃতি তৈরি করতে হলে ফুটপাতের কোন বিকল্প নেই। দোকান মালিকদের যদি বোঝানো যায় যে পরিস্কার ফুটপাত মানে আরো মধ্যবিত্ত ক্রেতা। তখন এ ক্রেতারাই তাদের ফুটপাতের অবৈতনিক রক্ষক হিসেবে কাজ করবে। লাইসেন্সধারী হকারদের শহরের কিছু স্থানে স্বল্পমূল্যেও বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে পুর্নবাসিত করা সম্ভব। অবমুক্ত ফুটপাত শুধু হাঁটার সংস্কৃতিকেই উৎসাহিত করবে না, একটি নগরে সবুজ অর্থনীতি তৈরিতেও সাহায্য করবে। কারণ কম গাড়ি মানে কার্বনমুক্ত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়া।
এভাবে চিন্তা করলে আমরা যানজট সমস্যার সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো। কিন্তু বাস্তবতা হলো ঢাকার যানজটের সামগ্রিক সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র নগর পরিকল্পনা বা যানবাহন প্রকৌশলের মাধ্যমে সম্ভব নয়। কারণ যানজট শুধু রাস্তার সমস্যা নয়, এটা এক হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং নাগরিক দুর্ব্যবহারেরও ফসল। এ কারণে পাঁচ ধরনের চালককে এগিয়ে আসতে হবে যানজট সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের লক্ষ্যে। এরা হলেন: রাজনৈতিক সরকার, পরিকল্পনাবিদ/সড়ক প্রকৌশলী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যম। এ পাঁচ চালকের কাজের প্রকৃতি ভিন্ন, কিন্তু লক্ষ্য অভিন্ন।
রাজনৈতিক সরকার:
ক. রাজনৈতিক সরকারকে দলীয় স্বার্থের ওপরে উঠে কিছু নীতিমালাকে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার সাথে বাস্তবায়িত করতে হবে।
প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষার বিকেন্দ্রীকরণ:
১. ঢাকাকে ভারমুক্ত করতে হলে প্রশাসনিক কিছু দফতরকে অন্য শহরে নিয়ে যেতে হবে। এর ফলে বেসরকারি খাতেরও বিকেন্দ্রীকরণ হবে।
২. অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ করতে বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পকে ঢাকার নগর সীমানার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঢাকায় অন্তত ২০ লাখ তৈরী পোশাক কর্মীর বসবাস রয়েছে।
৩. সারা দেশের মোট ৮২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০টিই ঢাকায়। সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অন্যান্য শহরে
স্থানান্তরিত করার নীতিমালা তৈরি করতে হবে জরুরিভিত্তিতে।
৪. বিডিআর সদর দফতর এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টকে ঢাকার বাইরে নেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু হোক এখনই।
জাতীয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণঃ
ঢাকায় ঘন্টাপ্রতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (৫০+) পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার ২০০ জন মানুষ ভাগ্য অন্বেষণে ঢাকায় ঢুকছে। প্রকৃতপক্ষে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, যদি দেশের জনসংখ্যাকে এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না যায়। এটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ন্যাশনাল পপুলেশান কাউন্সিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
জাতীয় মহাসড়ক পরিকল্পনাঃ
একটি-দুটি মহাসড়ক চিন্তা না করে, একটি দীর্ঘমেয়াদী মহাসড়ক পরিকল্পনা করার সময় এখনই। সারা দেশকে নিয়ে আসতে হবে একটি মহাসড়ক গ্রিডের আওতায়। এ মহাসড়ক গ্রিডে থাকবে তিন ধরনের নম্বর দেয়া সড়ক: জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক এবং অভ্যন্তরীণ শাহরিক সড়ক। জাতীয় মহাসড়ক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর জনসংখ্যার সুষম বন্টন অর্থনৈতিক প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ওতপ্রোতভাবে নির্ভরশীল।
সাপ্তাহিক গাড়িমুক্ত দিবসঃ
ঢাকায় শহর সীমানার ভেতরে একদিন হোক সাপ্তাহিক গাড়িমুক্ত দিবস। কলম্বিয়ার বেগোটায় গণপরিবহন ব্যবহার এবং কার্বনমুক্ত চেতনায় শহরবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে বার্ষিক গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হচ্ছে। ঢাকায় সপ্তাহে একদিন পুরোপুরি রিকশানির্ভর হতে অসুবিধা কোথায়? সাপ্তাহিক গাড়িমুক্ত দিবস শহরবাসীকে দূষণমুক্ত পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করবে এবং সরকারকে একটি জাতীয় সবুজ নগরায়নের নীতিমালা তৈরিতে সাহায্য করবে।
খ. পরিকল্পনাবিদ, সড়ক ও প্রকৌশলী মহলঃ
১. ঢাকার জন্য একটি উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম দ্রুতগামী জনপরিবহন ব্যবস্থা (বাস, ট্রেন এবং জল টেক্সিকে সমন্বয় করে) পরিকল্পনা করতে হবে। এটা সম্ভব, যদি এর পেছনে প্রত্যয়ী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। পাতাল রেলের সম্ভাবনা জরুরিভিত্তিতে যাচাই করা প্রয়োজন। আমাদের প্রতিবেশী শহর কলকাতায় ১৯৮৫ সালে শুরু হওয়া পাতাল রেলের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা যেতে পারে অনেক কিছুই। কলকাতায় প্রতিদিন দমদম কাজী নজরুল লাইনে পাঁচ থেকে আট লাখ লোক যাতায়াত করছে।
২. একটি জাতীয় ফুটপাত নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। হাঁটার সংস্কৃতি তৈরি করতে একটি সুষ্ঠু পথিকবান্ধব ফুটপাতনীতির বিকল্প নেই। নাগরিক পথিক সংস্কৃতি কার্বনমুক্ত অর্থনীতি তৈরিতে অনেকাংশে সাহায্য করবে।
৩. বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের জন্য সড়ক বিভক্তির সৃষ্টিশীল সমাধান প্রয়োজন। এ ধরনের সমাধানের জন্য সড়ক প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদদের প্রচুর মাঠপর্যায়ের গবেষণা করতে হবে। ব্যাংকক, বোগোটা এবং ব্রাজিলের কুরুচিবা শহরের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার আছে অনেক কিছু।
৪. পরিকল্পনাবিদ, সড়ক ও প্রকৌশলী মহল ঢাকা শহরের জন্য একটি জনচত্বর (পাবলিক প্লেস) নীতি প্রণয়নে পেশাগত পরামর্শ দিতে পারেন। একটি শহরের পরিচিতি নির্ভর করে তার মানসম্পন্ন জনচত্বরের ওপর।
৫. আঞ্চলিক বাসস্টেশনগুলোকে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্তে সরিয়ে নিতে হবে।
৬. সরকারকে একচেটিয়া দোষারোপ না করে পরিকল্পনাবিদ, সড়ক ও প্রকৌশলী মহল বরং তাদের সুচিন্তিত মতামত জানাতে পারেন যে, ঢাকায় কী কী করা সম্ভব।
গ.প্রশাসনিক মহল (রাজউক, ডিসিসি)ঃ
১. একটি দক্ষ জনপরিবহন ব্যবস্থা তৈরি করতে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে প্রশাসনিক মহলকে। বোগোটার ট্রান্সমিলেনিও যেমন, তেমনি ঢাকাতেও জনপরিবহন রাজধানীর উন্নয়নের প্রতীক হয়ে দাঁড়াতে পারে।
২. স্কুলবাস কার্যক্রম নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ কেন্দ্র। সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলোকে এ নীতিমালার আওতায় আনতে হবে। বেসরকারি স্কুলগুলো তাদের নিজস্ব বাস কার্যক্রম চালু করলে আংশিক করমুক্তি দেওয়া যেতে পারে।
৩. সাপ্তাহিক গাড়িমুক্ত দিবস প্রতিষ্ঠা করা যায়।
৪. ঢাকাবাসীকে গাড়ি শেয়ার করার ধারণায় উদ্ধুদ্ধ করা দরকার। একই বাসা থেকে যদি তিনজন পেশাজীবী একই কর্মস্থলে যান, তাহলে একেক দিন একেক জনের গাড়িতে যাওয়াটা হবে একটি সুস্থ সংস্কৃতি। এরকম সংস্কৃতির চর্চা যতো বেশি হবে, রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা ততোই কমবে এবং জ্বালানি তেলের সাশ্রয় হবে।
৫. বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের জন্য সড়ক বিভক্তির নীতিমালা বাস্তবায়িত করার দায়িত্বও প্রশাসনিক মহলেরই।
৬. পথিকবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে জনচত্বর (পাবলিক প্লেস) গড়ে তোলা হবে আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা এ ধরনের স্থানের অন্যতম উদাহরণ।
৭. রিক্সাকে না উঠিয়ে যুগোপযোগী করতে হবে। কম পেশীশক্তিতে আরও গতি এবং যাত্রীর জন্য টেকসই আসন নিশ্চিত হয়– এমন রিকশা প্রকল্পে বিনিয়োগ আহ্বান করা যেতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বে কার্বনমুক্ত শহরের ইচ্ছায় রিকশা হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়। নিউইয়র্ক, কোপেনহেগেন, স্টকহোম এবং অসলোর দিকে তাকালেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
৮. তরুণ প্রজন্মকে পরিবেশ সচেতন করে তুলতে সরকারকে বিনিয়োগ করতে হবে।
ঘ. সুশীল সমাজঃ
১. নগর পরিবেশ সচেতনতা তৈরি করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব সুশীল সমাজের। এ থেকেই গড়ে উঠবে নগরকল্যাণ চেতনা এবং পরিবেশ নীতিবোধ। প্রসঙ্গত, বাপা এবং বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে।
২. সরকার এবং নগর প্রশাসনের কাছ থেকে অবিরত জনপরিবহন এবং টেকসই নগরায়ন নীতিমালা দাবি করাও সুশীল সমাজের কর্তব্য।
৩. শুধু পরিবেশ সচেতনতাই নয়, পরিবেশ সংরক্ষণে দায়িত্ব পালনেও নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
ঙ. গণমাধ্যমঃ
১. নাগরিক দায়িত্ব ও পরিবেশ নীতিবোধ তৈরিতে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে পর্যাপ্ত স্থান ও সময় দিতে হবে।
২. গাড়ি মালিকানার তথাকথিত সামাজিক সম্মানকে নিরুৎসাহিত করতে আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে গণমাধ্যমকেই।
৩. টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থা একটি নাগরিক অধিকার এবং চলমান শহরের মাপকাঠি। এটি নগর প্রশাসন এবং সরকারকে অবিরত জানানোর জন্য গণমাধ্যমকে ভূমিকা রাখতে হবে।
৪. রাস্তাঘাটের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এক ধরনের নাগরিক মূল্যবোধ। এটা শহরবাসীকে বোঝাতে হবে গণমাধ্যমের শক্তি দিয়ে।
৫. হাঁটার সংস্কৃতি তৈরি করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে পরিবেশ নীতিবোধ
তৈরিতে ভূমিকা রাখতে হবে গণমাধ্যমকেই।
৬. নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠিত করতে নগর প্রশাসনের দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য গণমাধ্যমকে নিতে হবে দৃঢ় ভূমিকা।
সর্বোপরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার পাশাপাশি যানজটের সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসগুলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য। বর্তমানে অনেক গবেষণা হচ্ছে- কেন কিছু জায়গায় উন্নয়ন হয় আবার কোথাও হচ্ছে না। কিছু-কিছু গবেষক আজকাল দাবি করছেন যে, উন্নয়ন এক ধরনের মনোবৃত্তি। তার মানে হলো মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক গড়ন তাদের সার্বিক উন্নয়নের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ঢাকা শহরে আমরা সবাই দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে চাই। অথচ প্রায়ই আমরা নিজ নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে শ্রদ্ধাশীল নই। সামান্য প্রয়োজনে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে যাওয়া, যেখানে-সেখানে গাড়ি রেখে দেওয়া, তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য ছোট রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ে আরো দশটি গাড়িকে আটকে দেওয়া, ৩০০ গজ যেতেও রিকশায় উঠে পড়া– এই ধরনের নাগরিক দায়িত্বহীনতাকে কোটি-কোটি টাকার ফ্লাইওভার বা পাতাল রেল দিয়ে ঠিক করা যাবে না। এই ধরনের অপব্যবহার কি আমাদের বাঙালিত্বের মজ্জায়?
ভেনেজুয়েলার লেখক কার্লোস র্যাঙ্গেল দাবি করেছেন, দক্ষিণ আমেরিকার গোলমেলে এবং অস্থির সামাজিক পরিস্থিতির কারণ খুঁজে পেতে শুধু ঔপনিবেশিক শোষণকে দায়ী করলে চলবে না। বরং আইবেরিয়ান সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাথে এ মহাদেশের অনুন্নয়ন ধারার সম্পর্ক দেখতে হবে।
হাইতির ক্রমাগত অনুন্নয়নের ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মার্কিন লেখক লরেন্স হ্যারিসন দাবি করেছেন, হাইতির কালো জনগোষ্ঠীর ভেতরে জাগতিক উন্নয়নের প্রতি একধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব এবং যে কোন ধরনের পরিকল্পনার প্রতি অবিশ্বাস তাদেরকে দারিদ্র্যের বজ্র আঁটুনির ভেতর আটকে রাখে। এর মানে হলো যে কোন ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রত্যেক মানুষকে তার নিজের ভূমিকায় এবং উন্নতি করার মানসিকতায় বিশ্বাসী হতে হবে।
ঢাকার যানজট নিরসনে নগর প্রশাসন বা সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়। নগরবাসীকেও তাদের নাগরিক দায়িত্ব পালনে সচেতন এবং রাস্তার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমরা হাহাকার করতে পারি যে, ঢাকার মাত্র ৬৭টি সড়ক মোড়ে সিগন্যাল আছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, শিক্ষিত ব্যবসায়িক কর্মকর্তারা কাওরান বাজারে যেখানে-সেখানে গাড়ি রেখে দেন, তখন সড়কের প্রস্থ কমে গিয়ে তৈরি হয় দুর্বিসহ যানজট। যানজট নিরসনে প্রথাগত নাগরিক ব্যবহারের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
কাজেই যানজট নিরসন যেমন একদিকে প্রশাসনিক এবং সড়ক প্রকৌশলীর দায়িত্ব, অন্যদিকে নাগরিক মূল্যবোধহীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধও।
নব্বই দশকের শেষ দিকে বোগোটার মেয়র এনরিকে পেনিয়ালোসা তার শহরের রাস্তাগুলোকে রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক মাফিয়া এবং তাদের পরিবহন ব্যবসার দখল থেকে অবমুক্ত করে গণপরিবহন ব্যবস্থা এবং একটি গণচত্বর নীতিমালার আওতায় এনেছিলেন। এ কারণে রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা তাকে মেয়রের অফিস থেকে বহিস্কারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু পেনিয়াসোলার গণমুখী নগরনীতি শুধু তাকে রাজনৈতিকভাবেই টিকিয়ে রাখেনি, তাকে করেছে বোগোটার ইতিহাসের অন্যতম সফল মেয়র। ঢাকার নগর সমস্যা অনেক। কিন্তু পৃথিবীর অনেক শহরের উদাহরণ (মেক্সিকো সিটি, বোগাটা, ব্যাংকক, ব্রাজিলের কুরুচিবা) স্বরূপ বলা যায় ঢাকাকেও অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল একটি পরিবেশবান্ধব শহরে পরিণত করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পরিবেশবান্ধব নগর নীতিমালা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার সুষম সমন্বয়। যানজটের কাছে আত্মঘাতী সমর্থন নয়, বরং ধরে নিতে হবে এক ধরনের নাগরিক নীতিবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে যানজট নিরসনে সৃষ্টিশীল উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই।